[গাইড] ঘরে এবং বাইরে লাউ বীজ এর উৎপাদন

বাগানে প্রস্তুতকৃত লাউ গাছের রক্ষণাবেক্ষণ

বীজ তৈরি করাঃ

ট্রে/ প্রোপাগেটরে রাখা লাউ বীজ
  • একটি বাটি জলপূর্ণ করে তাতে বীজ দিয়ে ৭০ – ৭৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় রাখুন।
  • এগুলোকে ২৪ – ৪৮ ঘন্টা জলে রেখে দিন। তার থেকে বেশি সময় রাখলে অঙ্কুরোদগমের পরিবর্তে ওগুলো পঁচে যাবে।
  • পর্যাপ্ত সময় পার হবার পর বীজগুলোকে জল থেকে তুলে আলাদা পাত্রে রাখুন।
  • লাউ বীজের সাধারণত প্রায় ৭-১২ দিন সময় লাগে অঙ্কুরোদগম হতে।
  • একবার শুধু অঙ্কুরোদগম হয়ে গেলে, বীজগুলো বাইরে বীজতলায় বা ঘরে পাত্রের ভেতর রোপন করার উপযুক্ত হয়।  

প্রয়োজনীয় মাটিঃ

  • মাটির pH হওয়া প্রয়োজন ৫.৫ থেকে ৬.৮ যা এ্যালকালিনের থেকে অম্লীয় হবে
  • মাটির ক্ষেত্রে আপনি বাগান থেকে নিতে পারেন এক ভাগ মাটি, এক ভাগ কোকো পিট, এক ভাগ কেঁচো সার অথবা দুই ভাগ বাগানের মাটির সাথে এক ভাগ জৈব সার মিশিয়েও ব্যবহার করতে পারেন- যেভাবে আপনার সুবিধা হয়।
  • অথবা আপনি অর্ধ-পাতা পঁচা সার কিংবা আবর্জনা থেকে তৈরিকৃত সারও ব্যবহার করতে পারেন।
  • গাছের জন্য মাটির অনুকূল তাপমাত্রা হওয়া উচিৎ ৫০ – ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট।

লাউগাছ বৃদ্ধির টাইমটেবিল (শুরু – ২য় সপ্তাহ)

পর্যায়এ পর্যায় পর্যন্ত আসতে যে সময় লেগেছে
উদ্গম পর্যায়অঙ্কুরোদ্গম হতে ৬-৮ দিন সময় লাগবে এবং ছোট অঙ্কুর দেখা যাবে।
বীজপত্রঅঙ্কুরোদ্গমের দ্বিতীয় সপ্তাহে যে মিথ্যা পাতা দেখা যায়, তা দেখা যাবে।
প্রথম পাতা গজানোবীজপত্র গজানোর পরে, এ পর্যায়ে গাছে সত্যিকারের পাতা গজাবে অঙ্কুরোদ্গম পর্বের পর। 
চারা পর্বদ্বিতীয় সপ্তাহের পর, বীজটি উদ্ভিদে পরিণত হয়।
পৃথকীকরণ পর্বদ্বিতীয় সপ্তাহ শেষ হলে প্রতিটা চারাকে একটা পাত্রে রাখুন। ছোট, দুর্বল চারাগুলোকে কাঁচি দিয়ে কেটে বাদ দিয়ে দিন। 

বাইরে বীজ বপনের ক্ষেত্রেঃ  

  • বাগানে আগে থেকে তৈরিকৃত বীজতলায় বীগগুলোকে বপন করুন যেখানে চারাগুলো পর্যাপ্ত রোদ পাবে এবং শক্তিশালী বায়ু-প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা থাকবে না।
  • বীজগুলোকে ৩ × ৩ ফুটের পর্যাপ্ত জায়গা নির্ধারণ করে বপন করা উচিত, যেখানে প্রতিটি নির্ধারিত স্থানে দুটো করে বীজ বপন করতে হবে।
  • দুর্বল চারা এবং যে বীজগুলো থেকে চারা গজাবে না, সেগুলোকে বাদ দেওয়ার পর মূলত প্রতি বর্গ ফুটে একটা করে চারা থাকবে।
  • আঙুল দিয়ে মাটিতে জায়গা করে বীজগুলোকে সামান্য চাপ দিয়ে মাটির ভেতর ঢুকিয়ে দিন। এভাবে করার পর হাত দিয়ে সাবধানতার সাথে মাটিচাপা দিন বীজগুলোকে।
  • মাটিতে বীজ বপনের পরপরই সেগুলোকে সামান্য জলসেচ দিন।

ঘরের ভেতর বীজ বপনের ক্ষেত্রেঃ 

  • আপনার যদি বাইরে তেমন জায়গা না থাকে, আপনি ঘরের ভেতরেও লাউ বীজ লাগাতে পারেন।
  • বড় এবং গোল কোনো কন্টেইনার নিন যেমন ১০ সে.মি./ ৪ ইঞ্চির কোনো পাত্র এবং দুটো বীজ বপন করুন তাতে। আপনি এয়ারিং কাপবোর্ড, গ্রো ব্যাগ কিংবা প্রোপাগেটরও ব্যবহার করতে পারেন চাইলে। 
  • পাত্রের নিচে ছিদ্র করে দিন যেন চারাগুলো শ্বাস নিতে পারে এবং অতিরিক্ত জল ঠিকঠাক মতো বেরিয়ে যেতে পারে সেখান থেকে।
  • আলতো করে বীজগুলোকে মাটিতে পুতে দিন এবং হাত দিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিন। 
  • বপনের পরপরই সামান্য জলসেচ দিন বীজগুলোকে। 
  • আপনার পাত্র বা কন্টেইনারটি এমন একটি স্থানে রাখুন যেখানে তা পর্যাপ্ত সূর্যালোক পাবে এবং শক্তিশালী বাতাসে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।

বীজের জন্য প্রোপাগেটর এর ব্যবহারঃ

আপনি লাউ বীজের অঙ্কুরোদগম দ্রুত করার জন্য প্রোপাগেটরও ব্যবহার করতে পারেন। ব্যাপারটা অনেকটা নিজস্ব প্লান্ট ইনকিউবেটর থাকার মতো, যেখানে আপনি নিজেই তাপমাত্রা এবং বাতাসের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।.

  • একটি বীজের ট্রে নিন এবং তা সার দিয়ে পরিপূর্ণ করুন।
  • একটি কাঠের টুকরো ব্যবহার করে মাটিকে এদিক-ওদিক সরিয়ে সমান করুন যেন অতিরিক্ত মাটি না থাকে।
  • বীজ ছড়ানোর সময় মাথায় রাখা জরুরি যে, একই গর্তে প্রায় ২ – ৩ টা বীজ ২.৫ সে.মি. – ৩ সে.মি. গভীরতায় বপন করা হবে।
  • বীজ বপনের সময় মনে রাখতে হবে যে, অল্প অল্প করে যেন মাটিতে বীজ ছিটানো হয় কারণ অন্য যেকোনো কারণ ছাড়াও শুধু গায়ে গায়ে হবার কারণেই অধিকাংশ বীজ অঙ্কুরোদ্গমের আগেই মারা যেতে পারে।
  • বীজ বপনের আগে প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা পড়ে নেওয়া প্রয়োজন যে, কেমন দূরত্বে এবং কতটুকু গভীরতায় বীজগুলো বপন করা উচিত কারণ অঞ্চলভেদে লাউ বীজের ভেতর বৈচিত্র রয়েছে।
  • এরপর একটি চালনী দিয়ে বীজগুলোর উপরে খানিকটা করে সার দিয়ে দিন যেন সেগুলো মাটির পৃষ্ঠ থেকে সঠিক দূরত্বে থাকে।
  • মাটিতে বীজ বপনের পরপরই সেগুলোকে সামান্য জলসেচ দিন।
  • আপনার প্রোপাগেটরটি আপনার উইন্ডো সিল বা বেলকনীতে রাখুন বা এমন কোথাও রাখুন যেখানে সেগুলো পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পাবে এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারবে।

বেশি জায়গা ছাড়াই চারা পালনঃ

  • আপনার যদি যথেষ্ট জায়গা না থাকে, আপনি যেকোনো পাত্রে করেও তা পালন করতে পারেন আপনার বেলকনীতে রেখে।
  • গাছের লতানে অংশকে আপনি কোনো জালিতে বা ছাদে তুলে দিতে পারেন যদি আপনার তেমন সুযোগ থাকে।
  • আপনি যদি গাছটিকে আপনার বাড়ির টেরেসে বড় করেন, তবে আপনি লতানে অংশটা বেড়ার গায়ে তুলে দিতে পারেন যাতে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে টেরেসের বাইরের দিকের দেয়ালে।

সাপোর্ট হিসেবে জালির ব্যবহারঃ

লাউয়ের জন্য জালি

লাউ গাছগুলো হলো এমন গাছ যা খুব দ্রুত এবং বেপরোয়াভাবে বেড়ে ওঠে। আপনার তাই উচিত জালি ব্যবহার করে এটা নিশ্চিত করা যে, এর লতানে অংশ যেন ঠিকঠাকভাবে ওর মতো করে বেড়ে উঠতে পারে কোনো রকম বাধা ছাড়াই। এটা তখনই বিশেষভাবে প্রয়োজন যদি আপনার বাগানে এদের পালন করার মতো যথেষ্ট জায়গা না থাকে।

  • আপনি এদের খোলা জায়গা বা বাগানেও চাষ করতে পারেন যদি আপনার যথেষ্ঠ জায়গা থাকে কারণ এরা ১২ ফুটের ওপরে জায়গা নিয়ে নেবে।
  • অবশ্য এক্ষেত্রে লাউয়ের আকৃতিতে কিছুটা প্রভাব পড়ে কারণ এগুলো নিচের দিক থেকে চেপে যায়।
  • তাই আপনি এগুলোকে জালি দিয়ে বাড়তে দিতে পারেন।
  • জালি দিয়ে শক্ত একটা সাপোর্টিং এর ব্যবস্থা করুন যা প্রায় ৫ – ৬ ফুট উচ্চতার হবে।
  • জালিটি আপনি বাঁশ, পাইপ, দড়ি, তার বা এমন যে কোনো কিছু দিয়েই বানাতে পারেন যা অন্তত গাছকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো মজবুত হবে এবং গাছের ওজন ধরে রাখতে পারবে।

লাউ-এর চারা রোপনঃ

লাউ-এর চারা
  • লাউ-এর চারাগুলো ১ – ২ ফুট উচ্চতার হলে এবং তাতে বেশ কিছু পাতা গজানো শুরু করলেই সেগুলো রোপন করার জন্য আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
  • বাগানের মাটি কুপিয়ে, তাতে পর্যাপ্ত সার মিশিয়ে প্রস্তুত করে রাখুন।
  • এটা নিশ্চিত করুন যে মাটি শুকনো আছে, যাতে করে পরে আপনাকে অনুপযোগী ফলন পেতে না হয়।
  • মাটিতে আপনি যে গর্ত করবেন তা যেন এমন গভীর এবং চওড়া হয় যাতে গাছের চারার শেকড় তাতে ধরে যায়।
  • পাত্র, প্রোপাগেটর বা যাতেই আপনি চারাটিকে রেখেছিলেন না কেন, তা থেকে তোলার সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন। প্রথমে এক হাত পাত্রের মাটিতে রেখে গাছের গোড়া ধরুন এবং অন্য হাত পাত্রের নিচে রাখুন।
  • এরপর মাটি থেকে তুলে চারাটিকে বাগানের মাটিতে পুতে দিন এবং প্রয়োজনমতো জলসেচ দিন।

পুরুষ/ স্ত্রী ফুল এবং পরাগমিলনঃ

স্ত্রী লাউ ফুলের নিচে একটি থলির মতো অংশ থাকে
  • প্রতিটি লাউ গাছেই পুরুষ এবং স্ত্রী, এই দুই ধরনের ফুলই থাকতে পারে।
  • পুরুষ ফুলগুলো আগে ফুটতে দেখা যায় গাছে। এগুলোর নিচে ডাটার কাছে কোনো বল আকৃতির কিছু থাকে না।
  • স্ত্রী ফুলগুলো পরে ফোটে। এদের গোড়ার দিকে ছোট লাউয়ের মতো আকৃতি দেখতে পাওয়া যায়।  
  • লাউ লতায় সাধারণত পুরুষ ফুলগুলোই আগে ফোটে। তবে আপনি লাউ লতায় বেশি বেশি করে স্ত্রী ফুলও ফোটাতে পারবেন ডাটার গোড়ার প্রান্তীয় অংশ কেটে দিয়ে।
  • গাছ সাধারণত পরাগমিলনের ক্ষেত্রে পোকামাকড়ের উপর নির্ভর করে। অবশ্য আপনার বাগানে পোকামাকড় কম থাকলে আপনি হাত দিয়েও গাছের পরাগমিলন ঘটাতে পারেন।  

হাত দিয়ে লাউয়ের পরাগমিলন (ঐচ্ছিক):  

  • লাউ গাছের পুরুষ এবং স্ত্রী ফুল চিহ্নিত করুন।
  • মসলিন কাপড়ের তৈরি দড়ি দিয়ে মুখ আটকানো যায় এমন ব্যাগ দিয়ে ফুলগুলোকে আবৃত করে দিন। এরপর দড়ি টেনে দিন এবং বেঁধে দিন।
  • প্রাকৃতিকভাবে যখন ফুলগুলো ফুটবে, তখন ব্যাগের আচ্ছাদনটি সরিয়ে ফেলুন।
  • পুরুষ ফুলটিকে স্ত্রী ফুলের মুখোমুখি এনে আলতো করে চেপে ধরুন যেন ফুলগুলোর ভেতর পুষ্পরেণুর আদান-প্রদান হয়।
  • এছাড়াও আপনি একটা পুরুষ ফুল ছিঁড়ে , স্ত্রী ফুলের সাথে ঘষেও পরাগমিলন ঘটাতে পারেন। সাধারণত একটা পুরুষ ফুল দিয়েই একাধিক স্ত্রী লাউ ফুলে পরাগমিলন ঘটানো সম্ভব। 
  • এছাড়াও ক্রস পলিনেশন ঠ্যাকাতে আপনি ব্যাগ দিয়ে ফুলগুলোকে ঢেকে দিতে পারেন। এভাবে অন্তত ৪৮ ঘন্টার মতো ঢেকে রাখতে হবে।
  • আবার, আপনি ব্রাস দিয়ে পুরুষ ফুল থেকে রেণু তুলে স্ত্রী ফুলে দিয়ে পরাগমিলন ঘটাতে পারেন। এ কাজটা ২-৩ দিনের মতো করতে হবে।
  • কাজ হোক বা না হোক, পরবর্তী ২৪ ঘন্টার ভেতর ফুল নেতিয়ে পড়বে এবং আপনাকে জানিয়ে দেবে যে পরাগমিলন এবং সার দেওয়া সফল হয়েছে কিনা।

লাউ উত্তোলনঃ

লাউ-উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত
  • দুই মাসের ভেতরেই আপনার লাউ গাছ থেকে লাউ তোলা যাবে। সাধারণত সব লাউ গাছের ক্ষেত্রেই ৫০-৬০ দিনের বেশি লাগে না।
  • পরবর্তী তিন মাস আপনি গাছ থেকে লাউ তুলতে পারবেন।
  • ধারালো ছুরি বা কাস্তে দিয়ে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে গাছের ডাটা থেকে লাউ কেটে নেবেন।
  • ৩-৪ ইঞ্চি ডাটা রেখে দিয়ে তারপর কাটবেন লাউ ডাটা।
  • আপনি যদি লাউ ডাটা বেশি বেশি করে কেটে ফেলেন, তাহলে গাছ বেশিদিন বাঁচবে না।

পরবর্তী বারের জন্য প্রস্তুতিঃ

  • অভিনন্দন! আপনি সাফল্যের সাথে লাউ চাষে সক্ষম হয়েছেন।  
  • উৎপাদিত লাউ শুকিয়ে নিন এবং একটা ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে আলগা করুন।
  • ভেতর থেকে নরম অংশগুলোকে বের করুন এবং একটি বাটি বা থালায় রাখুন।
  • নরম মণ্ডময় অংশ থেকে বীজগুলোকে আলাদা করুন। শুধু সেই বীজগুলোকেই সংরক্ষণ করুন যেগুলো পরিপক্ব হয়েছে এবং বিবর্ণ নয়।
  • বীজগুলোকে একটি আদ্রতামুক্ত পরিবেশে সংরক্ষণ করুন, যেমন কোনো খামে বা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ব্যাগে। তারপর সেগুলোকে কোনো ঠাণ্ডা এবং অন্ধকার স্থানে সংরক্ষণ করুন যেন পরবর্তী মৌসুমে ব্যবহার করতে পারেন।

Similar Posts